খোদ বেনারসি পল্লীকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিক্রয় কেন্দ্রে নেই বেনারসি। বিদেশী পোষাকের দাপটে হারাতে বসেছে বেনারসি। অব্যাহত লোকসান আর মহামারি করোনার ঝাপটায় প্রায় নিভুনিভু রংপুরের ঐতিহ্যবাহী বেনারশি পল্লী। বিক্রয়কেন্দ্রেগুলোতে এখন বেশির ভাগই জায়গা করে নিয়েছে ভারত-পাকিস্তানের শাড়ি-থ্রীপিচসহ অন্যান্য কাপড়। দেশীয় তৈরী তাতেঁর বাজার সম্প্রসারিত না হওয়ায় ও বিদেশী প্রযুক্তির কাছে পিছিয়ে পড়ায় দেশীয় তাতেঁর হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। সরেজমিনে জানা যায়, রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তার কোলঘেষা তালুক হাবু গ্রামে গড়ে ওঠে এই বেনারসি পল্লীটি। এসময় গ্রামের ঘরে ঘরে তাঁতের শব্দে মুখর থাকতো দিন রাত। কিন্ত এখন ভরা ঈদ মৌসুমেও তাঁতপল্লীতে সুনসান নীরবতা। তিন-চার বছর আগেও বেনারসি পল্লীতে দেড়’শ এর বেশি মালিকের ছোট বড় ৪শ’ থেকে ৫শ’ টি তাঁত ছিল। এখানে কাজ করতেন ছয় হাজার শ্রমিক। বর্তমানে এখানকার ৯০ ভাগই তাতঁ বন্ধ। শ্রমিকদের কাজ নেই। তাঁত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাদের তৈরিকৃত শাড়ীগুলোর সূতা, প্রসেসিং এবং কাটিংয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষেপন হওয়াতে আস্তে আস্তে কমে এসেছে কারখানার সংখ্যাও। এসব সঙ্কট না কাটতেই চলমান পরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে সূতাসহ অন্যান্য কাঁচামাল সরবারহ ও শাড়ি প্রসেসিং করতে না পারায় হতাশায় রয়েছেন কারখানার মালিকরা। যার প্রভাবও পরেছে শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের উপর। তালুক হাবু এলাকার তাঁত কারখানার প্রথম উদ্যোক্তা আব্দুর রহমান জানান, ১০ বছর আগেও এই এলাকার প্রায় প্রত্যেকটি ঘরে তাঁত উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছিল। আর তাতেই বেনারসি পল্লীর নামকরণের স্বার্থকতা ফুটে উঠেছিলো সুনামের সাথে। কারখানা মালিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ ও সরকারের অনেকটা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নিভু নিভু আজ এই পল্লীটি। ব্যবসা গুটিয়ে এখন এই পল্লীতে ছোট বড় ৮-১০ টি কারখানা টিকে রয়েছে কোনমতে। পল্লীতে আয়শা বেনারসির কারখানা ও শোরুমের মালিক আলমগীর ইসলাম জানান, ‘গত ১৫ বছর ধরে অনেক চড়াই উৎরাই পার করে ধরে রেখেছি এই কারখানাটিকে। বর্তমানে তার কারখানায় ১২ টি মেশিনে ২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। করোনাকালে তার কারখানা প্রায় বন্ধের উপক্রম। স্থানীয় শোরুমগুলেতে তাদের উৎপাদিত শাড়ী না নেয়ার অভিযোগ করে আলমগীর বলেন, উৎপাদিত শাড়িগুলো সহজে প্রসেসিং ব্যবস্থা, কাঁচামাল সরবারহের সহজলভ্যতাসহ স্থানীয় শোরুমে বিক্রির ব্যবস্থা থাকলে এই ব্যবসা টিকে রাখা সম্ভব। নয়তো অচিরেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে অন্য চিন্তা করতে হবে। কারখানার শ্রমিক আনোয়ার হোসেন জানান, একটি শাড়ি বুনতে সময় লাগে ৭-৮ দিন। আর মজুরি পান ২৫০০ টাকা। এদিয়ে সংসার চালানো খুব কষ্টকর। করোনা সংক্রমণ রোধে পরিবহন লকডাউনে উৎপাদিত শাড়ি ঢাকায় প্রসেসিং করে বিক্রি করতে না পারায় মালিক নিয়মিত মজুরি দিতে পারছেনা। তাই করোনা কালে সরকারী প্রণোদনার দাবিও করেন আনোয়ারসহ কারখানায় শ্রম দেওয়া অন্য শ্রমিকরা। তালুক হাবু এলাকার তাঁত কারখানাগুলোকে ঘিরে সেখানে তিস্তা বেনারশি, নিশাত, আয়েশা, রেখা বেনারশি ১০-১২টি বিপণন কেন্দ্র বা শোরূম গড়ে উঠেছে। এসব শোরুমে- ব্রোকেট কাতান, পিরামিড কাতান, মিরপুরী রেশমি কাতান, বেনারসি কসমস, চুনরি কাতান, প্রিন্স কাতান শাড়ি বিক্রি হয়। তবে দিন দিন কারখানার সংখ্যা ও উৎপাদন কমে যাওয়ায় এসব কারখানাতে বেনারসি শাড়ির পাশাপাশি ঢাকা ও ইন্ডিয়া থেকে আনা শাড়ি বিক্রি করছে বলে জানান স্থানীয়রা। নিশাত শোরুমের বিক্রেতা রবিউল জানান, ‘করোনার প্রভাবে শোরুমে বেচা কেনার অবস্থা খুব খারাপ। আর কয়েক দিন পরেই ঈদ অথচ এই সময়ে আমাদের অলস সময় পার করতে হচ্ছে।’ রেখা বেনারসি শোরুমের ম্যানেজার জানান, করোনার কারণে শোরুমে অনেক দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতার আসতে পারেনা। ফলে বেচা কেনা খুব কম। ঈদের এই সময়ে অন্যান্য বার দিনে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বিক্রি হতো এখন দিনে ৫০ হাজারো বিক্রি হচ্ছেনা।’ দোকানে কর্মচারির বেতন দেওয়াও দূরহ হচ্ছে বলে জানান তিনি। এদিকে বেনারসি পল্লীকে টিকে রাখার জন্য সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক লোন ব্যবস্থা করা দরকার বলে জানান রংপুর চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু। উল্লেখ্য, রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গঙ্গাচড়া উপজেলাতে গড়ে উঠেছে এই বেনারসি পল্লীটি। ২০০৫ সালে প্রায় ১০০ তাঁতি ওই এলাকায় বেনারসি পল্লী গড়ে তোলেন। মঙ্গাকবলিত এ উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের তালুক হাবু গ্রামসহ আশপাশের আরা ৪-৫টি গ্রামে এ শিল্পের বিকাশ ঘটছে। এক সময় প্রায় ৫০০ তাঁত ছিল বেনারসি পল্লীতে। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদিত কাপড়ের বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, শ্রমিক সংকট, স্থানীয়ভাবে সুতা না পাওয়া এবং প্রসেসিং ও কাটিং মেশিন না থাকাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তা কমতে কমতে ২০-এর নিচে নেমে গেছে।